১৫০ বছর ধরে স্ব-মহিমায় নারায়ণগড়ের গনুয়ার কালী

সংবাদ সারাদিন, পশ্চিম মেদিনীপুর: মাত্র কয়েক বছর হল তৈরি হয়েছে মন্দির, তার অগে খোলা আকাশের নীচেই প্রায় ১৫০ বছরের বেশি সময় ধরে পুজিতা হচ্ছেন নারায়ণগড় ব্লকের গনুয়ার কালী মা। কথিত আছে এখান কার দেবী জাগ্রত, সমস্ত ভক্তদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেন।আর এই কারনে লক্ষ্যাধিক মানুষের সমাগম হয় এই গনুয়ার কালী মায়ের পুজোকে কেন্দ্র করে।

জেলার প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী কালীপূজাগুলির মধ্যে একটি অন্যতম পশ্চিম মেদিনীপুরের নারায়ণগড় ব্লকের নারায়ণগড় থানার অন্তর্গত গনুয়ার কালীপুজো। যেখানে শুধুমাত্র কালীপুজোর একটি দিন প্রায় লক্ষাধিক মানুষের সমাগম হয়।এই পুজো কে কেন্দ্র করে রয়েছে একটি পূজো কমিটি।পূজা উপলক্ষে বসে মেলা। লক্ষাধীক পুণ্যার্থীর ভিড়।আর এই ভিড় সামলাতে থাকে বিপুল পরিমাণে পুলিশি ও স্বেচ্ছাসেবক দিয়ে সুরক্ষার ব্যবস্থা। বাঁশের ব্যারিকেড দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয় সমস্ত মন্দির চত্বর। ভিড়ের মাঝে বহু মানুষ তাদের পরিজনদের হারিয়ে ফেলেন আর তাদের সন্ধান পেতে থাকে অনুসন্ধান অফিস। এছাড়াও থাকে খাবার জন্য পানীয় জলের ব্যবস্থাও। সব মিলিয়ে একদিনের এই কালী পুজোর আড়ম্বরতা জেলার বড় ঐতিহ্যবাহী পুজো গুলির মধ্যে একটি অন্যতম কালী পূজ।

তবে এ বছর করোনা পরিস্থিতির জন্য সেই আড়ম্বরপূর্ণ পুজো আর হচ্ছে না। বসছে না মেলা। থাকছে না লক্ষাধীক মানুষের ভিড়ে ঠাসা পরিস্থিতি।পুজো কমিটির অন্যতম সদস্য শক্তিপদ ঘোড়াই জানান-” করোনা ভাইরাস এর জন্য এবছর পুজোর পরিস্থিতি একটু অন্যরকম, বিগত বছরগুলোর মতো এবছর আর সেই ভাবে পুজো হবে না। শুধুমাত্র কুলপি রক্ষার্থে পুজো হবে। মালিক এবং মন্দিরের সেবাইত তারা পুজো দিবেন। সেই সঙ্গে দেশ কমিটির পক্ষ থেকে একটি ডালা সহ যোগে পূজ দেয়া হবে। আর কোন দর্শনার্থী বা পুণ্যার্থী এখানে আসতে পারবেন না।”

পুজো কমিটির সভাপতি রণজিৎ সাহু জানান-“এখান কার কালী মায়ের একটি ঐতিহ্য রয়েছে। সেই ঐতিহ্য মেনে পুজো হবে। তবে এবছর কোন পুণ্যার্থী পুজো দিতে পারবেন না। কোন দর্শনার্থীর এখানে ভিড় করা চলবে না। তাই আমরা আগাম মাইকিং করে এলাকার আসে পাশে এমনকি স্থানীয় পত্রপত্রিকা ও সংবাদমাধ্যমের মাধ্যমে প্রচার শুরু করে দিয়েছি।”

এই দেবী নাকি সবং থানার বেলকি-র সাউ পরিবারের অর্থাৎ সাউ বাড়ির জায়গাতেই মায়ের আবির্ভাব। কথিত আছে সাউ পরিবারের এক মেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরে দুরারোগ্য কঠিন ব্যাধিতে পরিণত হয়। মেয়ের চিকিৎসার জন্য তৎকালিন প্রতিপত্তিশালি সাউ পরিবার মেয়ে কে কলকাতা থেকে শুরু করে রাজ্যের বহু জায়গায় নিয়ে গেছেন কিন্তু কোন লাভ হয়নি। অবশেষে মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় ট্রেনেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে মেয়েটি। কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে শোকে ভেঙে পড়ে পরিবারের লোকেরা। তখনই সাউ পরিারের তৎকালীন কর্তাকে স্বপ্নাদেশ হয় যে কোথাও গিয়ে কোনও লাভ হবে না মেয়েকে যদি সুস্থ করতে হয় তা হলে গনুয়া যাও। ওখানে তোমাদের জায়গায় মাটি চাপা হয়ে আছি আমি সেখান থেকে আমাকে বের কর। আমার পুজো শুরু কর। এই স্বপ্নাদেশ পেয়ে তত্ক্ষণাত সাউ পরিবারের লোকজনেরা গোনুয়ার আজকে যে জায়গায় মন্দির স্থাপিত হয়েছে সেখানে যান। গভীর জঙ্গল কেটে শুরু হয় খনন কার্য।যা পাওয়া যায় তা হল দুটি কালো পাথর আর একটি ত্রিশূল। আর তাতেই ভক্তি ভরে মায়ের পুজো শুরু করেন সাউ পরিবারের লোকজনেরা। সঙ্গে থাকে অসুস্থ মেয়েটিও। পুজো শুরু হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত মেয়েটি। এতো ডাক্তার বৈদ্য যে মেয়েকে সুস্থ করতে পারেনি দুটো পাথরের পুজো করার পরেই সুস্থ হয়ে ওঠে মেয়েটি। এই খবর যখন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে তখনই মানুষ নিজেদের অসুবিধার কথা জানিয়ে মায়ের কাছে মানত করতে থাকেন।কথিত আছে সকলেরই মনোস্কামনা পূর্ণ করেন গনুয়ার কালী মা। সেই থেকে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে মায়ের কাছে পুজো দেওয়ার ভিড়। আজ সেই পুজো লক্ষাধিক মানুষের ভিড়ে পরিণত হয়েছে।

বহু দিন ধরে পারিবারিক পুজো থাকলেও মানুষের অতিরিক্ত ঢলের কারণে এই পুজোকে সার্বজনীন রূপ দিতে হয়। বিগত দশ বছর ধরে সর্বজনীন পুজো হিসেবে পূজিতা হচ্ছেন গোনুয়ার কালী মা। পুজো সর্বজনীন রূপ পাওয়ার পর গ্রামের মানুষ পুজো কমিটি প্রশাসনের কাছে খোলা আকাশের নিচে মায়ের পুজো যাতে করতে না হয় তার জন্য মন্দির তৈরি করার আবেদন জানান। অবশেষে প্রশাসন এবং গ্রামবাসীদের উদ্যোগে মায়ের মন্দির নির্মিত হয়। বিগত ক-এক বছর ধরে সেই মন্দিরেই পূজিত হচ্ছেন গোনুয়ার জাগ্রত কালীমায়ের। তবে এবছর করোনা পরিস্থিতির জন্য পুজো কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শুধুমাত্র কালীপুজোর ২ দিন নিত্যপুজো বন্ধ থাকছে। তবে ঐতিহ্য মেনে চতুর্দশীর পুজো হবে। আর সেই পুজোতে শুধুমাত্র সাউ পরিবার অর্থাৎ মালিকপক্ষ এবং মন্দিরের সেবাইত ও দেশ কমিটির পক্ষ থেকে পুজো দেওয়া হবে।

Spread the love