সংবাদ সারাদিন, রতুয়া: ক্যাগের প্রতিনিধি দল তদন্ত করে যাওয়ার পর যেন আতঙ্কের সুনামি চলছে রতুয়া-২ ব্লকের শ্রীপুর-২ গ্রাম পঞ্চায়েতে। কথাই বলতে চাননি পঞ্চায়েত প্রধান সেরিনা বিবি। মুখে কুলুপ পঞ্চায়েত সদস্যদেরও। তবে শাসকদল পরিচালিত এই পঞ্চায়েতের প্রধান যে কোটি কোটি টাকার আর্থিক দুর্নীতিতে জড়িত তা খোলা গলায় জানাচ্ছেন এলাকার বাসিন্দারাও। তাঁরাও প্রকৃত তদন্ত সাপেক্ষে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের আর্জি জানাচ্ছেন। সবাই এখন ক্যাগের তদন্ত রিপোর্ট আর তার ভিত্তিতে কলকাতা হাইকোর্ট কী রায় দেয়, তা জানতে মুখিয়ে রয়েছেন।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালের ডিসেম্বরে শ্রীপুর-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের বিরুদ্ধে ১০০ দিনের কাজ প্রকল্পে একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ এনে কলকাতা হাইকোর্টে জনস্বার্থে মামলা দায়ের করেন এলাকার বাসিন্দারা। তাদের অভিযোগ এনিয়ে তাঁরা প্রথমে জেলা শাসকের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। জেলা শাসক অভিযোগের তদন্ত করার জন্য রতুয়া-২ ব্লকের জয়েন্ট বিডিওর নেতৃত্বে চারজনের একটি কমিটি গঠন করে দেন। তদন্তে অনেক অনিয়ম ধরা পড়ে। এনিয়ে প্রধানকে শোকজও করা হয়। পঞ্চায়েত আইন অনুযায়ী তাঁর সদস্যপদ খারিজের জন্য চাঁচল মহকুমা আদালতে মামলা রুজু হয়। কিন্তু তার শুনানি এখনও পর্যন্ত হয়নি। শেষ পর্যন্ত তিনজন গ্রামবাসী কলকাতা হাইকোর্টে জনস্বার্থে মামলা দায়ের করে। এরপর থেকেই তাঁদের খুনের হুমকি দেওয়া শুরু হয়। সেই হুমকির জন্য বাকি দুই মামলাকারী মামলা থেকে নিজেদের নাম তুলে নিলেও এক জন অজ্ঞাতবাসে থেকেই এই মামলা লড়ে যাচ্ছেন।
এই মামলায় চারবার শুনানির পর কলকাতা হাইকোর্ট তদন্তের ভার দেয় ক্যাগকে। গত মঙ্গলবার ক্যাগের একটি প্রতিনিধি দল গ্রাম পঞ্চায়েত দপ্তরে দীর্ঘ সময় তদন্ত চালিয়েছে। ওই দলের প্রতিনিধিরা বেশ কয়েকটি গ্রামে গিয়ে কেন্দ্রীয় প্রকল্পের কাজ খতিয়েও দেখেন। তদন্ত শেষে তাঁরা কলকাতা ফিরে গিয়েছেন। তবে তাঁরা যে পঞ্চায়েত কর্তৃপক্ষের কাজকর্মে সন্তুষ্ট হতে পারেননি তা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অন্তত দুই পঞ্চায়েতকর্মী জানিয়েছেন, তদন্তে দুর্নীতির বিষয়টি ক্যাগের সামনে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। তবে কত টাকার দুর্নীতির খোঁজ তারা পেয়েছে তা জানা যায়নি। তবে তদন্তে যে প্রধান ও তাঁর সহযোগীদের ওপর খাঁড়ার ঘা নেমে আসছে তা নিশ্চিত।
মালদা জেলা কংগ্রেসের প্রাক্তন সহ-সম্পাদক মোঃ মাসুদ আলম জানিয়েছেন ২০১৮ সালে সারা বাংলায় পুলিশকে হাতে করে বুথ দখল করে সমস্ত পঞ্চায়েত দখল করেছিল তৃণমূল কংগ্রেস। তারপর থেকে তারা সরকারি অর্থ তছরুপ এবং উপভোক্তাদের নামে ভূয়ো বিল করে প্রধান ও পঞ্চায়েতের কিছু সংখ্যক সদস্যরা একত্রিত হয়ে অর্থ তছরুপ করেছে। এরপর রতুয়া-২ ব্লকের শ্রীপুর-২ গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার আপামর জনসাধারণ তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ করেন প্রশাসনিক সর্বস্তরে। কিন্তু দীর্ঘ দিন অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পরেও প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় তারা তখন বাধ্য হয়ে কলকাতা হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেন।এরপর কলকাতা হাইকোর্ট ক্যাগকে তদন্তের নির্দেশ দেয়। শ্রীপুর-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান সেরিনা বিবির ছেলে ওয়াসিম আকরামের ফার্মে ১০০ দিন প্রকল্পের কাজ দিয়েছে এবং কাজ না করে সেই প্রকল্পের টাকা একাউন্টে ক্রেডিট করে আত্মসাত করেছে।যা পঞ্চায়েত আইনে অবৈধ। ওই গ্রাম পঞ্চায়েতের দু,জন সদস্য প্রধান সেরিনা বিবির বিরুদ্ধে এসডিও সাহেবকে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন কিন্তু এসডিও সাহেব এখনো পর্যন্ত হেয়ারিং করেননি। তারপর তারা আদালতের দ্বারস্থ হই। আদালতের নির্দেশে ক্যাগ তদন্ত চালাচ্ছেন আমরা আশা করছি ক্যাগ একটা নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করবে। প্রধান সেরিনা বিবির স্বামী মোহাব্বাত আলী এবং তার ছেলে ওয়াসিম আকরামের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকা সত্ত্বেও পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করছে না। রাজ্য সরকার এইসব দুষ্কৃতীদের বাঁচানোর জন্য এসডিও, বিডিও থেকে শুরু করে সরকারি আধিকারিকদের কাজে লাগাচ্ছে।আমাদের আইনের ওপর আস্থা রয়েছে এই ক্যাগের তদন্তে মালদা জেলায় লুটতারাজ যেমন বন্ধ হবে তেমন সাধারণ মানুষের কাজ হবে।
পঞ্চায়েত প্রধান এনিয়ে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হতে না চাইলেও এলাকার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দুর্নীতির ছবি পাওয়া গিয়েছে। ৭-৮ মাস আগে ১০০ দিন কাজ প্রকল্পের বোর্ড লাগানো থাকলেও কাজের কোনও চিহ্ন নেই। কোথাও বা কাজের বোর্ড খুলে রাখা হয়েছে পাশে। এনিয়ে চাতর গ্রামের সাজ্জাদ আলি সাফ জানান, ‘১০০ দিনের কাজ প্রকল্পে এই গ্রামের কবরস্থানটার সংস্কার হওয়ার কথা ছিল। তার বোর্ডও লাগানো হয়। কথা ছিল, কবরস্থানটি ফাইবার ব্লক দিয়ে মুড়ে ফেলা হবে। করা হবে সীমানা প্রাচীর, মাটি ফেলে উঁচু করা হবে পুরো অংশটাই। কিন্তু তার কিছুই হয়নি। পরে খবর নিয়ে জানতে পারি, কাগজকলমে সব কাজ হয়ে গিয়েছে। তার বিল হয়ে টাকাও তুলে নেওয়া হয়েছে। এই টাকা প্রধান আর তার ছেলেই আত্মসাৎ করেছে। কিছু বলতে গেলে তারা খুনের হুমকি দিচ্ছে। আমরা চাই, এর প্রকৃত তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হোক।’
স্থানীয় নিজামুদ্দিন শেখ বলেন, ‘১০০ দিনের কাজ প্রকল্পে প্রায় সাড়ে ১৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন শ্রীপুর-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান। তাঁর নিজের ছেলে, দেওরের ছেলের নামে ঠিকাদারি লাইসেন্স রয়েছে। তারাই এই প্রকল্পের বিভিন্ন কাজ দেখিয়ে টাকা আত্মসাৎ করেছে। এমনকি কাজ না করেও টাকা তোলা হয়েছে। এরা গরিব মানুষের টাকা নিজেদের পকেটে পুরেছে। এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।’
এলাকার হিন্দুপাড়ার বাসিন্দা গণেশ চৌধুরী বলেন, ‘১০০ দিনের কাজ প্রকল্পে গ্রামের রাস্তাটা পাকা হওয়ার কথা ছিল। প্রায় আট মাস আগে কাজের বোর্ডও লাগানো হয়েছিল। কিন্তু তার কাজ শুরুই হয়নি। রাস্তার কাজ আর হবে কিনা জানি না। আমরা চাই, রাস্তাটা হোক। কী হবে, কে জানে?’
তবে এই বিষয়ে মালদা জেলা তৃণমূল কংগ্রেসের জেলা সভাপতি আব্দুর রহিম বকসি জানিয়েছেন, দুর্নীতি হয়েছে কিনা তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিছুই বলা যাবে না। যারা বলছেন তৃণমূল দুর্নীতিগ্রস্ত এই অভিযোগ যারা তুলছেন তারা জীবনে বহু দুর্নীতি করে এতদূর এসে পৌঁছেছেন। তৃণমূল কোনো দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত থাকে না। যদি কেউ ব্যক্তিগতভাবে দুর্নীতি করে থাকে সেটি তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। সারা পশ্চিমবাংলা জুড়ে তৃণমূল কংগ্রেস স্বচ্ছ ও সততার সঙ্গে কাজ করছে।